তিস্তা বাঁধ স্থাপিত হয়েছে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে। লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা উপজেলার গাডিমারী ইউনিয়নের দোয়ানী গ্রামে ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এই বাঁধ নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৯০-এ মূল বাঁধ নির্মাণ কার্যক্রম শেষ হয়, অন্যান্য কাজ বাকী থাকে। ৬১৫ দশমিক ২৪ মিটার দীর্ঘ এই বাধেঁর উদ্দেশ্য ছিল ৬ লাখ কিউসেক পরিমাণ পানি শুষ্ক মৌসুমে সেচের জন্য বিভিন্নখাতে প্রবাহিত করা। ৭টি জেলার ৩৫টি উপজেলার ১৩ লাখ ৩৫ হাজার একর জমি সেচের আওতায় এনে ফসল ফলানের লক্ষ্যে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বৃহৎ তিস্তা প্রকল্পের আওতায় তিস্তা বাঁধ নির্মাণের সূত্রপাত করে।
তিস্তা ব্যারেজ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা নদীর উপর নির্মিত একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প। এটি প্রধানত জলসম্পদ নিয়ন্ত্রণ এবং কৃষি সেচের জন্য ব্যবহৃত হয়। এখানে কিছু বিস্তারিত তথ্য:
1. অবস্থান ও নির্মাণ
- অবস্থান: তিস্তা ব্যারেজটি কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি উপজেলায় অবস্থিত।
- নির্মাণের সময়কাল: ১৯৬০-এর দশকে নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৯৬২ সালে এটি কার্যক্রম শুরু করে।
2. কার্যক্রম ও উদ্দেশ্য
- জলসেচ: ব্যারেজটি তিস্তা নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে, যা কৃষি জমিতে সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ করে।
- বন্যা নিয়ন্ত্রণ: এটি নদীর জলস্তর নিয়ন্ত্রণে সহায়ক, যা বন্যার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
- অর্থনৈতিক সুবিধা: সেচ সুবিধার মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো এবং স্থানীয় অর্থনীতি উন্নয়নে অবদান রাখে।
3. প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য
- দৈর্ঘ্য: প্রায় ২.৫ কিলোমিটার।
- উচ্চতা: প্রায় ১৫ মিটার।
- মোট গেটের সংখ্যা: ৪৪টি গেট।
4. প্রভাব ও চ্যালেঞ্জ
- সেচ সুবিধা: ব্যারেজের মাধ্যমে কৃষকদের জন্য সেচ সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে, যা গ্রীষ্মকালীন ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে।
- পরিবেশগত প্রভাব: নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের কারণে কিছু স্থানীয় পরিবেশগত পরিবর্তন ঘটেছে, যেমন নদী সংলগ্ন এলাকার জলস্তরের পরিবর্তন।
- বিভিন্ন সমস্যা: কখনও কখনও পানির অভাব বা অতিরিক্ত পানি সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, যা স্থানীয় জনগণের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
5. সম্ভাব্য উন্নয়ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
- নির্মাণের উন্নতি: ব্যারেজের সঞ্চালন কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক উদ্যোগ চলছে।
- স্থানীয় সমাজের সহায়তা: স্থানীয় জনগণের জন্য প্রশিক্ষণ এবং সহায়তার মাধ্যমে কৃষি প্রযুক্তির উন্নয়ন করা হচ্ছে।
তিস্তা ব্যারেজ বাংলাদেশের জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং কৃষি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তিস্তা ব্যারেজ বাংলাদেশের জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও এটি বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। এখানে কিছু মূল সমস্যা তুলে ধরা হলো:
১. পানি সেচের সমস্যা
- অনিয়মিত পানি সরবরাহ: তিস্তা ব্যারেজের মাধ্যমে পানি সরবরাহের অনিয়মিততা কৃষকদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বিশেষত, শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ ঠিকমতো না পাওয়ার কারণে ফসলের উৎপাদন কমে যায়।
- উত্তরাঞ্চলের কৃষি নির্ভরতা: তিস্তার ওপর কৃষি নির্ভরতা বেশি হওয়ায়, ব্যারেজের কার্যকারিতা সঠিক না থাকলে কৃষি উৎপাদনে প্রভাব পড়ে।
২. পরিবেশগত প্রভাব
- নদী পরিবেশের পরিবর্তন: ব্যারেজ নির্মাণ ও পরিচালনার ফলে তিস্তা নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ পরিবর্তিত হয়েছে, যা নদীর পরিসর, জীববৈচিত্র্য এবং স্থানীয় পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
- পানি স্তরের পরিবর্তন: নদীর পানি স্তরের পরিবর্তনের কারণে আশপাশের এলাকার জলাবদ্ধতা বা শুষ্কতা দেখা দিতে পারে।
৩. বন্যা ও পানি সঞ্চালন সমস্যা
- বন্যা নিয়ন্ত্রণের সমস্যা: যেভাবে ব্যারেজটি পানি নিয়ন্ত্রণ করে, তার ফলে কখনও কখনও অতিরিক্ত পানি বা বন্যার ঝুঁকি বাড়তে পারে। ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা না হলে এটি স্থানীয় বন্যা পরিস্থিতিকে খারাপ করে দিতে পারে।
- পানি সঞ্চালন হ্রাস: নদীর উজানের দেশগুলোর পানি সঞ্চালন হ্রাসের কারণে তিস্তার প্রবাহ কমে গেছে, যা ব্যারেজের কার্যকারিতা প্রভাবিত করে।
৪. বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ
- স্থানীয় জনগণের জীবিকা: পানি ব্যবস্থাপনার সমস্যা স্থানীয় জনগণের জীবিকা ও জীবনযাত্রার মানের উপর প্রভাব ফেলেছে। অনেক পরিবার কৃষি আয়ের উপর নির্ভরশীল, এবং পানি সমস্যার কারণে তাদের আয় কমে যাচ্ছে।
- অবকাঠামোগত অসুবিধা: ব্যারেজের অবকাঠামো কখনও কখনও পুরনো হয়ে যাওয়ার কারণে maintenance ও আপগ্রেডের প্রয়োজন হয়, যা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
৫. অন্যান্য চ্যালেঞ্জ
- মৌসুমি পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌসুমি পানি প্রবাহের অবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে, যা ব্যারেজ পরিচালনায় নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
এসব সমস্যা মোকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে, কিন্তু সমাধান একে একে সময়সাপেক্ষ ও জটিল হতে পারে। তিস্তা ব্যারেজের কার্যকারিতা ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।
তিস্তা ব্যারেজ বাংলাদেশে জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি নানা ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। এখানে কিছু প্রধান বিপদের বর্ণনা দেওয়া হলো:
১. বন্যার ঝুঁকি
- অতিরিক্ত পানি: বর্ষা মৌসুমে তিস্তার অতিরিক্ত পানি প্রবাহ ব্যারেজের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতে পারে, যা আশপাশের এলাকায় বন্যার সৃষ্টি করতে পারে।
- বন্যার প্রকৃতির পরিবর্তন: পানি প্রবাহের অসামঞ্জস্য বন্যার ধরণ পরিবর্তন করতে পারে, যা স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার উপর প্রভাব ফেলতে পারে।
২. পানি সংকট
- শুষ্ক মৌসুমে পানি অভাব: শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে সেচের জন্য পর্যাপ্ত পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে, যা কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
- উজানের দেশগুলির প্রভাব: ভারতের উপরিভাগে জলব্যবস্থাপনার পরিবর্তনের কারণে তিস্তার প্রবাহ কমে যেতে পারে, যা বাংলাদেশে পানি সংকট তৈরি করে।
৩. পরিবেশগত সমস্যা
- জলাবদ্ধতা ও শুকনো মরু: ব্যারেজের কারণে নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে জলাবদ্ধতা বা শুকনো মরু পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যা জীববৈচিত্র্য ও কৃষি উভয়ের জন্য ক্ষতিকর।
- জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: নদীর পরিবেশে পরিবর্তন এবং পানি প্রবাহের হেরফের জীববৈচিত্র্য হ্রাস করতে পারে, বিশেষত মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য।
৪. অবকাঠামোগত সমস্যা
- ব্যারেজের অবস্থা: পুরনো হওয়া ব্যারেজের অবকাঠামোগত সমস্যা যেমন গেটের ক্রুটি, পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা প্রভৃতি কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে।
- মেন্টেনেন্স চ্যালেঞ্জ: নিয়মিত মেন্টেনেন্স এবং সংস্কার না হলে ব্যারেজের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে, যা স্থানীয় জনগণের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করে।
৫. সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
- কৃষকের সমস্যা: পানি সংকট ও অন্যান্য সমস্যার কারণে কৃষকদের আয় কমে যেতে পারে, যা তাদের জীবনযাত্রার মান প্রভাবিত করে।
- স্থানীয় সম্প্রদায়ের চাপ: পানির অভাব বা অতিরিক্ত পানি স্থানীয় সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার মান ও তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
৬. বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ
- আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সমঝোতা: ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে মতভেদ এবং আন্তর্জাতিক চুক্তির সমস্যা রয়েছে, যা পানি ব্যবস্থাপনায় প্রভাব ফেলতে পারে।
- জলবায়ু পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নদীর প্রবাহের প্রকৃতি ও মৌসুম পরিবর্তিত হতে পারে, যা ব্যারেজের পরিচালনায় নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
এসব সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য সঠিক পরিকল্পনা, তত্ত্বাবধান, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবিলা করা সম্ভব।