জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ঘোষিত 'মুজিববর্ষ' উদযাপনের মহাপরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এ উপলক্ষে বছরজুড়ে দেশ-বিদেশে ২৯৮টি আয়োজনের সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত হয়।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ৬ জুলাই আওয়ামী লীগের এক যৌথ সভায় জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে 'মুজিববর্ষ' উদযাপনের ঘোষণা দেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী আগামী ১৭ মার্চ। তাই সরকার ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ 'মুজিববর্ষ' উদযাপনের ঘোষণা দিয়ে উচ্চপর্যায়ের দুটি কমিটি গঠন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১০২ সদস্যের জাতীয় উদযাপন কমিটি এবং জাতীয় অধ্যাপক ও নজরুল-গবেষক রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ৬১ সদস্যের জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব এবং বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ গঠিত 'মুজিববর্ষ' উদযাপন কমিটিতে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
দেশের বাইরেও সাড়ম্বরে উদযাপিত হবে জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিববর্ষের আনন্দ আয়োজন। ইউনেস্কোও বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে মুজিববর্ষ উদযাপনের ঘোষণা দিয়েছে। গত ২৫ নভেম্বর প্যারিসে ইউনেস্কো সদর দপ্তরে সংস্থার ৪০তম সাধারণ অধিবেশনে সর্বসম্মতভাবে এ সিদ্ধান্ত হয়। ফলে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন আন্তর্জাতিক রূপ পেয়েছে।
গত শুক্রবার বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে সারাদেশে শুরু হয়েছে জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের ক্ষণগণনা(কাউন্টডাউন) ৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর তেজগাঁওয়ে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ক্ষণগণনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা ও বিপুল জনসমাগমের জায়গাগুলোতে এই ক্ষণগণনা শুরু হয়। এ জন্য সারাদেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের ২৮টি স্থান, বিভাগীয় শহর এবং ৫৩টি জেলা সদর ও দুই উপজেলা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ মোট ৮৩টি জায়গায় ক্ষণগণনার ঘড়ি বসানো হয়েছে ।
ড. কামাল আবদুল নাসের সমকালকে বলেন, মুজিববর্ষ উদযাপনে দেশের তৃণমূলের জনগণ থেকে শুরু করে সারাবিশ্বকে সম্পৃক্ত করা হবে। কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হবে। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে।
জমকালো উদ্বোধনঃ মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানমালা শুরু হয় ১৭ মার্চ থেকে। ওই দিন সূর্যোদয়লগ্নে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর তোপধ্বনি ও বিকেলে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে বর্ণাঢ্য উদ্বোধন অনুষ্ঠান হবে। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তি ও কর্মজীবন নিয়ে হলোগ্রাফিক উপস্থাপনা ও থিম সং পরিবেশিত হবে। এ ছাড়া জন্মশতবার্ষিকীর বিভিন্ন স্মরণিকা ও স্মারক বক্তৃতা প্রকাশ এবং দেশি-বিদেশি শিল্পীদের সমন্বয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ।
অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশঃ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (LDC) থেকে উন্নয়শীল দেশে উত্তোরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত কমিটি এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণে যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষনা দেয়। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানব সম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরত সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোন দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে। মাথাপিছু আয়ের মানদন্ড অনুযায়ী কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার থাকতে হবে। যা বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় থেকে অনেক কম। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম যেখানে, বাংলাদেশের রয়েছে ২৪.৮ ভাগ ।
বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় উঠে আসে, জন্মের ৫০ বছরের কম সময়ের মধ্যে কীভাবে বাংলাদেশ দ্রুতপতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতা দেখাতে পেয়েছে ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা: SDG অর্জন, SDG বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গ সমতা, কৃষি, দারিদ্রসীমা হ্রাস, গড় আয় বৃদ্ধি, ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল, রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দোর, পদ্মা সেতু, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ।
শিক্ষা খাতে অর্জনঃ শিক্ষা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে সরকার শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম নেয়। নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেবার জন্য চালু করেছে উপবৃত্তির ব্যবস্থা। বর্তমানে ২৬ হাজার ১৯৩ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করেছে। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ৬ টি হওয়া শিশুর শতকরা হার ৯৭.৭ ভাগ। গরিব ও মেধাবী ছাত্র- ছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে “শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট আইন-২০১২” প্রণয়নকরা হয়েছে।
স্বাস্থ্য সেবায় অর্জনঃ শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ বিশে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতকে যুগোপযোগী করতে প্রনয়ণ করা হয়েছে “জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা-২০১১”। তৃণমূল পর্যায় স্বাস্থ্য সেবা দিতে তৈরি করা হয় ১২ হাজার ৭৭৯ টি কমিউনিটি ক্লিনিক। ৩১২ টি উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে ৫০ শয্যায়। মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপাতালগুলোতে ২ হাজার শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। নবজাত মৃত্যু ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমেছে। স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে ১২ টি মেডিকেল কলেজ নির্মাণ ও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৪৭ হাজারেরও বেশি জনশক্তি ।
নারী ও শিশু উন্নয়নের অর্জনঃ নারীর সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে “জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১”। “জাতীয় শিশু নীতি-২০১১” প্রণয়নের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে শিশুদের সার্বিক অধিকারকে। দেশের ৪০টি জেলার সদর হাসপাতাল ও ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপন করা হয়েছে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল। দরিদ্র্যশীশুদের জন্য স্থাপন করা হয় ১৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র । এজন্য প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘ সাউথ এওয়ার্ডে ভূষিত করে।
নারীর ক্ষমাতায়নে অর্জনঃ পোশক শিল্পে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ। এই শিল্পের সিংহভাগ কর্মী হচ্ছে নারী। ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে ৮০% এর উপর নারী ।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনঃ দেশের প্রায় ৪৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে ইউনিয়ন পর্যায় ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫,০০০। মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি ৩৭ লক্ষ। ইন্টারনেটের গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ৪৬ লক্ষ। প্রযুক্তির মোবইল নেটওয়ার্ক বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার।
কৃষিতে কৃতিত্ব ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাঃ ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন। প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীর সরাসরি সহায়তায় বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম আবিষ্কার করেছেন পাটের জিনোম সিকুয়েন্সি। সারা বিশ্বে আজ পর্যন্ত মাত্র ১৭টি জিনোম সিকুয়েন্সিং হয়েছে যারমধ্যে ড. মাকসুদ করেছেন ৩টি।
প্রবাসী শ্রমিকদের উন্নয়নে অর্জনঃ বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭ টি দেশে বাংলাদেশের ৮৬ লক্ষ্যেরও অধিক শ্রমিক কর্মরত আছে। স্থাপন করা হয়েছে প্রবাসী কল্যান ব্যাংক। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২০ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা অভিবসন ঋণ বিতরণ করে এই ব্যাংক ।
বিদ্যুৎখাতে সাফল্যঃ বিদ্যুৎখাতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে রয়েছে জাতীয় গ্রীডে অতিরিক্ত ৬ হাজার ৩২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোজন, যার ফলে বিদ্যুতের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৭ শতাংশ থেকে ৬২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। শিল্প বাণিজ্য খাতে অর্জনঃ বর্তমানে বাংলাদেশ আইটি শিল্প হতে ১০ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় করেছে।
মন্দা মোকবেলায় সাফল্যঃ মন্দার প্রকোপে বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন বিপর্যস্থ ছিল বাংলাদেশ তখন বিভিন্ন উপযুক্ত প্রণোদনা প্যাকেজ ও নীতি সহায়তার মাধ্যমে মন্দা মোকাবেলায় সক্ষমই শুধু হয়নি, জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ শতাংশের বেশি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
সরকারের শীর্ষ মহা প্রকল্পঃ পদ্মা বহুমুখী প্রকল্প বাস্তয়নে মোট ব্যয় ধরা হয় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মেট্রোরেল প্রকল্প যা বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২৪ সালকে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
রাম্পাল বিদ্যুৎকেন্দ্রঃ মৈত্রী সুপার মার্শাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা । রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রঃ ২০১১ সালে রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রকল্পের চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৮৭ কোটি টাকা ।
দোহাজারি ঘুমধুম রেলপ্রকল্পঃ পর্যটন সুবিধা বাড়াতে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্প । মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রঃ গ্যাসের ক্রমবর্ধমান স্বল্পতার কারনে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের কাজ হাতে নেয় সরকার। ২০২৩ সাল নাগাদ এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে মনে করা হয়। পায়রা
গভীর সমুদ্রবন্দরঃ দেশের তৃতীয় গভীর সমুদ্রবন্দর এটি এলএনজি টারমিনালঃ এলএনজি ভাসমান টার্মিনাল। কাতারের রাষ্ট্রয়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান রাসগ্যাস লেকে সরাসরি এই গ্যাস কিনবে
সরকার। এর আনুমানিক ব্যয় ১৮ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরঃ এ প্রকল্পটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পরিশেষে বলা যায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ যেখানে রয়েছে বা বন্ধুর পথ পারি দেবার ইতিহাস। এ সকল অর্জন সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ তত্ত্বাবধান ও দূরদৃষ্টি পরিকল্পনার মাধ্যমে।