ঋণ খেলাপীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য পদক্ষেপ সমূহ
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতিকে কর্কট রোগের ক্রমবর্ধমান ভয়াবহতার সঙ্গে তুলনা করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিপিডি। পর্যবেক্ষণটি অস্বীকার কিংবা উপেক্ষা করার মতো নয়। এত দিন কেবল গুলখেলাপকেই ব্যাংকিং খাতের বড় সমস্যা হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু বলখেলাপি সংস্কৃতির প্রধান নিয়ামকগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই খাত সুশাসনের অধোগতি। খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির কথাই যদি ধরা যায়, তাহলে দেখা যায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা, পরবর্তী তিন মাসে এই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজার ৪০৯ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। কিন্তু খেলাপি ঋণের পরিমাণ নির্ধারণের সময় আমরা সব সময় অবলোপন করা পরিমাণ বিস্মৃত হয়ে থাকি, যদি আদর-দুরূহ খেলাপি বলেই ঋণ অবলোপন করা ৪২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা যুক্ত করে হিসাব করি, তাহলে দেশের প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। খেলাপি ঋণের বিপদের সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতি। এটি তখনই ঘটে যখন কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ এমন হারে বেড়ে যায়, যার বিপরীতে সংস্থান রাখার মতো যথেষ্ট মুনাফা হয় না। মার্চ ২০১৭ প্রান্তিকের শেষে ব্যাংকগুলোর মোট প্রভিশনের প্রয়োজনীয়তা ছিল ৪১ হাজার ৯২০ কোটি টাকা, যার বিপরীতে সব ব্যাংক মিলে সংরক্ষণ করতে পেরেছে মোট ৩৬ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতির পরিমাণ ৫ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। সাধারণ পাঠকদের জ্ঞাতার্থে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রভিশন হচ্ছে বিভিন্ন মেয়াদের খেলাপি ঋণের বিপরীতে বিভিন্ন হারে রাখা। মন্দঋণ এই সংস্থান রাখতে হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ যত বাড়াবে, তার সঙ্গে বাড়াবে সংস্থানের পরিমাণ এবং কমবে বণ্টনযোগ্য মুনাফা তথা লভ্যাংশের পরিমাণ। সাধারণের একটা ভুল ধারণা হচ্ছে ঋণ অবলোপন করা কিংবা খেলাপি ঋণের সংস্থান রাখা হয় জনগণের আমানত থেকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খেলাপি ঋণের বিপরীতে সংস্থান ব্যাংকের মুনাফা থেকেই সরিয়ে রাখতে হয়। সংস্থান থেকে ঋণ অবলোপন করা হয় বলে ক্ষতিগ্রস্থ হন ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০, ৫০ এবং ১০০ শতাংশ হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এমনকি খেলাপি হনত এখন ঋণের বিপরীতেরও ঋণের প্রকারভেদে ০.২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে সাধারণ সংস্থান রাখতে হয়। অবশ্য খেলাপি ঋণের বিপরীতে কোনো অস্থাবর সংম্পদ থাকলে তার মূল্যের অর্ধেক কিংবা নগদ জামানত থাকলে তার পূর্ণ মূল্য প্রয়োজনীয় সংস্থান থেকে বাদ দিয়ে সংরক্ষণের সুযোগ আছে।
আমাদের খেপি ঋণ, সংস্থান ও মূলধন ঘাটতি, মুনাফা বৃদ্ধির প্রতিযোগিতার কারণে ঋণ ব্যবস্থাপনায় আপস এবং সর্বোপরি প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন অন্তরায় যে আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে একটা নাজুক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সেটি উপলব্ধি করার জন্য সূক্ষ্ম গবেষণা কিংবা বিশেষজ্ঞের মতামতের প্রয়োজন হয় না। দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি এই খাতটিকে শক্ত ভিত্তির ওপর তুলে আনতে না পারলে আমাদের যাবতীয় অর্থনৈতিক অর্জন হুমকির মুখে পড়বে, এটি বিবেচনায় রেখেই সব পক্ষকে উপলব্ধি করতে হবে যে একটি দুর্বল ব্যাংকিং খাত নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী টেকসই উন্নয়নের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।